[New post] পাইস হোটেল কলকাতা | ইতিহাস, গল্প, ঘটনা, তথ্য
Best Indian Food Blog posted: " https://youtu.be/jFb0TBCYIRI কলকাতার খাবারের আসল স্বাদ মসলাদার বাণিজ্যিক বিরিয়ানির হাড়িতে বা বহুল প্রচলিত মোমোতে পাওয়া যায় না। এমনকি ঠাকুমার গোপন রেসিপি আবিষ্কার করেছে বলে দাবি করা অভিনব বাঙালী রেস্তরাতেও আপনি সে স্বাদ নিতে পারবেন না। কয়েক দশক " Best Indian Food Blog
কলকাতার খাবারের আসল স্বাদ মসলাদার বাণিজ্যিক বিরিয়ানির হাড়িতে বা বহুল প্রচলিত মোমোতে পাওয়া যায় না। এমনকি ঠাকুমার গোপন রেসিপি আবিষ্কার করেছে বলে দাবি করা অভিনব বাঙালী রেস্তরাতেও আপনি সে স্বাদ নিতে পারবেন না। কয়েক দশক ধরে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি পাইস হোটেলই রয়েছে যারা সাধারণ, ঘরোয়া ও স্বাস্থকর খাবার পরিবেশন করছে মূল্যবৃদ্ধিকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে। পাইস হোটেলের ইতিহাস আমাদের নিয়ে যায় সেই সময়ে যখন ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্য ও ইংরেজ পয়সার প্রচলন ছিল। পাইস ছিল এক আনার চার ভাগের এক ভাগ এবং এক টাকার চৌষট্টি ভাগের এক ভাগ। আপনি জানলে অবাক হবেন, সেই একশো বছর আগেও তারা যে খাবার পরিবেশন করতেন তার জন্য এক পয়সা দাম ছিল নাম মাত্র। তাই এর নাম পাইস হোটেল। পাইস হোটেল নাম পেয়েছে হিন্দি শব্দ পয়সা থেকে, যা ভারতীয় টাকার সর্বনিম্ন মূল্য। দক্ষ হাতে তৈরি সস্তা এবং স্বাস্থ্যকর, বাড়ির মতো খাবার পরিবেশন করার জন্য এর নাম এরকম হয়েছে। ১৯০০ শতকের গোড়ার দিকে যখন কলকাতা ছিল ঝাঁ চকচকে একটি মহানগর, তখন বাইরে থেকে কাজ করতে আসা মানুষদের খাবার যোগাতে কলকাতা শহরে জন্ম নিয়েছিল পাইস হোটেল। এই মানুষগুলো অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবিত্ত এবং একা, তারা রান্না করতে জানতেন না অথচ তারা তাদের বাড়ির খাবারের অভাব বোধ করতেন। এই পাইস হোটেল গুলো ঘরোয়া খাবারের সাথে ঘরোয়া অনুভুতি ও যত্ন দুইই দিতো এই ঘর পাগল মানুষ গুলোর জন্য। ভারতে ইংরেজ নাগরিকদের জন্য প্রথম খাবার পরিবেশন করে কফিহাউজ গুলো। কিন্তু পাইস হোটেলই ছিল শহরে জনগণের খাবারের জন্য তৈরি প্রথম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। অর্থনীতি কৃষি থেকে শিল্পে স্থানান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে লোকেরাও গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হতে থাকে, এবং এই মানুষগুলোর খাবারের চাহিদা পূরণ করতেই জন্ম হয়েছিল পাইস হোটেলের। প্রথম দিকে কিছু পাইস হোটেল মেসবাড়ির রান্নাঘর হিসেবে তৈরি হয়েছিল যেখানে ছাত্র এবং অফিস কর্মচারীদের সস্তায় থাকা ও খাওয়ার বাবস্থা ছিল। নিয়মিত তিনবেলা এই ঘরোয়া হিন্দু খাবার পরিবেশনের রীতিতে আমিষ খাবারের সাথে সাথে পেয়াজ রসুন ছাড়া নিরামিষ খাবারও থাকে যা কলকাতা শহরের সবথেকে পুরনো পাইস হোটেলে বসে নিজের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেবে। অধিকাংশ পাইস হোটেলগুলোই ছিল কঙ্কালসার। অনেক সময় গ্রাহকদের মেঝেতে পা ভাজ করে আসন করে বসতে হতো, যদিও কিছু পাইস হোটেলে খুবই সাধারণ মানের কাঠের বেঞ্চের বাবস্থাও ছিল। প্রতি টেবিলে একাধিক গ্রাহক একসাথে বসে খাবার খেলেও বিল হতো প্রতি জনের জন্য আলাদা আলাদা। খাবারের মেনু নির্ভর করত প্রতিদিনের বাজারে মেলা সামগ্রী আর সমসাময়িক ফলনের উপরে। কালো বোর্ডের উপর লেখা হতো প্রতিদিনের মেনু। বিলিং বব্যস্থা সম্পূর্ণ ভাবে পরিচালিত হতো ওয়েটারের দ্বারা আর তাদেরকেই মনে রাখতে হতো মেনু আর খাবারের অর্ডার। আপনি খাবেন, দাম দেবেন। এক চিমটি মৌরি মুখে দিয়ে চলে যাবেন। আপনার পেট ভরে যাবে। কিন্তু আপনার পকেটও বেশি হালকা হবে না। পাইস হোটেল গুলো সভাবসিদ্ধ ভাবেই ভিন্ন। খাবার পরিবেশন করা হতো কলা পাতায় আর গ্রাহকরা বসতেন মেঝেতে বা আসনে। পাইস হোটেল গুলো শুধুমাত্র বাংলার খাবারই পরিবেশন করত, কখনো কখনো পোস্ত বাটা দিয়ে আলু পোস্ত, কুমড়ো গাছের ফূল দিয়ে কুমড়ো ফুল ভাজা আবার অল্প মসলা দিয়ে চিংড়ি মাছ, নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি মাছের মালাইকরি, এই সবই থাকতো খাবারের তালিকায়। প্রতিদিন পালটে যেত পাইস হোটেলের মেনু, আর তা নির্ভর করত সেদিন সকালে বাজারে কি কি পাওয়া গেল তার উপরে। বাড়তি খরচ আর অপচয় কমাতে, কলাপাতা থেকে শুরু করে শেষ পাতের লেবুর টুকরো পর্যন্ত সবকিছুর দামই আলাদা করে হিসাব করা হতো । এই অতিসাধারণ খাওয়ার হোটেল গুলোর আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল, অন্তত কারো কারো তো ছিলই। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে এরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এবং এর সাথে যুক্ত মানুষদের কম দামে এবং বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করত। মুষ্টিমেয় কিছু দোকান তো সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্রয় দিত এবং সেখানে বসে গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা করা হতো । কিছু দোকানদার আবার দেশাত্তবোধে তাদের দোকানের নামই পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার পরে এম এন পান্ডা তার হোটেলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন "স্বাধীন ভারত"। স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাপদ গুহ তার হোটেলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন 'এয়ঙ্গ বেঙ্গল হোটেল' । ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকলেও অধিকাংশ পাইস হোটেলই আধুনিক সমাজের মূল্য বৃদ্ধি ও গ্রাহকদের আধুনিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়। এদের অনেকেই আজ আর নেই, আর এদের সাথেই হারিয়ে গেছে কলকাতার খাবারের গুরুত্তপূর্ণ অনেক ইতিহাস। তখনকার কিছু বিখ্যাত পাইস হোটেল তবুও নিজেদের বাচিয়ে রাখতে সখ্যম হয়েছে, ভাল খাবার, সাধ্যের মধ্যে দাম আর সঠিক পরিষেবা সব বাধাকে পাড় করেছে। তরুণ নিকেতনের সেই সতন্ত্র স্বাদে ভরা হাসের ডিমের ডালনা, সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের কবিরাজি পাতলা ঝোল অথবা জগন্নাথ আশ্রমের জিভে জলআনা চিতল পেটি, স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের জিওল মাছের ঝোল এখনো তাদের অনুগতদের নিয়ে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে। বাণিজ্যিকিকরনের মিছিলে মেঝেতে আসন সরিয়ে এসেছে চেয়ার আর টেবিল, কিন্তু এই পাইস হোটেলের সেই পরিষেবা এখনো একই ভাবে অম্লান। গ্রাহক এখনো কলা পাতার থালায় খাওয়ার প্রথাগত অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে পারেন তিন বেলায় মাত্র ২০০ টাকায়। আজও ভারতীয় শ্রমিক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যটক সকলেই এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকানগুলিতে আসতে পারেন কলকাতার সবচেয়ে খাটি বাঙালী রান্নার স্বাদ নেওয়ার জন্য।
No comments:
Post a Comment